শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমানের ভাগ্নি এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক পিএস- এই উভয় পরিচয়ে কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাবান। অন্যদিকে স্ত্রীর ক্ষমতায় মন্ত্রণালয়ের অধীন কর্মকর্তা ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ারও রাতারাতি হয়ে উঠেছিলেন মহা ক্ষমতাবান। যদিও ড. বখতিয়ার ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে, কিন্তু গোটা কৃষি বিভাগেই ছিল তার দাপট। এই স্বামী-স্ত্রীর দাপটে পুরো কৃষি বিভাগ ছিল তটস্থ। আর এর সুবাদে নিয়োগ-বদলি, প্রকল্প অনুমোদন, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা রকমের অনিয়মের মাধ্যমে কামিয়ে নিয়েছেন তারা শত শত কোটি টাকা। যার বেশিরভাগই বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৯টি অধিদপ্তর ও সংস্থা আছে। প্রতিটি সংস্থায় নিয়োগ, পদোন্নতি-পদায়নের ক্রাইটেরিয়া ছিল যোগ্যতার পরিবর্তে দুর্নীতিপরায়ণতা। ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার নিজেই ছিলেন বিএআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে চুক্তিভিত্তিতে। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এমনকি মহাপরিচালক কিংবা চেয়ারম্যান পদ ছাড়াও বিভিন্ন দপ্তরের অন্য পদেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অযোগ্য-অদক্ষ কর্মকর্তাদের। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে যেমন সময়ক্ষেপণ হচ্ছে, তেমনি কাজের মান নিয়েও দেখা দিচ্ছে প্রশ্ন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন শেখ বদিউল আলমের নেতৃত্বে সার সিন্ডিকেট যে লাগামহীন লুটপাট চালিয়েছে তাতেও ছিল এই স্বামী-স্ত্রীর কমিশন বাণিজ্য। তার সিন্ডিকেটের কাছ থেকে বড় অংকের কমিশন পেতেন এরা।
জানা যায়, স্ত্রী ওয়াহিদা আক্তার কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদে থাকাকালে সেই সুবাদে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পাঁচজনকে টপকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান পদ বাগিয়ে নেন ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তিনি হয়ে উঠেন অত্যন্ত বেপোরোয়া। চেয়ারম্যান পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ডক্টর শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার বিভিন্ন ধরণের অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। আত্মত্মসাত করেন সরকারি অর্থ। আর এসব কাজে ঠিকাদার রাজ ছিলেন তার অপকর্মের পরামর্শদাতা।
সার্ক কৃষি সেন্টারের অফিসের মোজাইক, টাইলস, সিলিং বোর্ড, পর্দা, ফার্নিচার এ সমস্ত কাজের ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন ড. বখতিয়ার। সার্ক কৃষি সেন্টারের পঞ্চম তলা থেকে ষষ্ঠ তলার বর্ধিতকরণ কাজটি একটি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও তাকে কাজ করতে দেয়া হয়নি। বরং পছন্দের ঠিকাদার রাজের প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য করেন তিনি। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট কাজে প্রস্তাবিত মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নিজস্ব ভবনে রাজ কনস্ট্রাকশনের একটি নিজস্ব ভবনে রাজ লাইতনিনাই শুনে অগ্রণী ব্যাংকের শাখা থাকায় ব্যাংক কর্মকর্তারা ঠিকাদার রাজের চেম্বার ও বহিরাগতদের কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে ওই সময়। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়া সার্ক কৃষি কেন্দ্রের পাবলিকেশন প্রিন্টিং এর জন্য তার কাছের একটি প্রেসকে টেন্ডার ছাড়াই কার্যাদেশ দেন। এতে অতিরিক্ত চারগুণ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
অন্যদিকে, বিএআরসি’র সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট এবং প্রোগ্রামার গ্রেড পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য পছন্দের দুই প্রার্থীর কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সার্ক কৃষি সেন্টারের পরিচালকের দায়িত্বে থাকাবস্থায় তিনি বিএআরসি’র পরিচালক হিসেবে আলাদাভাবে লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন উত্তোলন করেছেন। একই সাথে সার্ক থেকে প্রতিমাসে ৭৫০ ডলার করে ভাতা উত্তোলন করেছেন বলে জানা যায়। সরকারের কাছ থেকে বেতন নেয়ার পাশাপাশি ৬৯ মাসে সার্ক কৃষি সেন্টার থেকে প্রায় ৪৩ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন।
জানা যায়, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ) নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যার পেছনে বছরে ব্যয় হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মের অগ্রগতি বলা যায় একেবারে শূন্য। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নকাজে আর্থিক-কারিগরি সহায়তা দেওয়ার ঝান্ডা উড়িয়ে ২০০৭ সালে কেজিএফের আবির্ভাব ঘটে। রাজধানীর ফার্মগেটের এই প্রতিষ্ঠান আদতে জয়েন্ট স্টক নিবন্ধিত কোম্পানি। তবে যাত্রার পর থেকেই কেজিএফ হয়ে যায় অবসরে যাওয়া কৃষি কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে। কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে টাকা বরাদ্দ দেওয়া আর কয়েকটি প্রকাশনা বের করেই দায় শেষ। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকায় যে গবেষণা হয়, তা কতটা কার্যকর- সেটির তদারকিও হয় না। গেল ১৮ বছরে কৃষি খাতে প্রতিষ্ঠানটির তেমন অবদান না থাকলেও ঠিকই খোলা ছিল অনিয়মের দরজা। নিয়োগ দুর্নীতি, আত্মীয়করণ দলীয়করণ, ক্ষমতার অপব্যবহার করে আওয়ামীপন্থি একটি চক্র অনুদান লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০২২ সালে কেজিএফের বোর্ড ও জেনারেল বডির চেয়ারম্যান ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. শেখা বখতিয়ার। তখন তিনি ‘১০০ কৃষি প্রযুক্তি অ্যাটলাস’ নামে একটি বই প্রকাশে কেজিএফ থেকে ৮৫ লাখ টাকা খরচ করেন। এই টাকার অধিকাংশই তছরুপ হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। পরে আরও চারটি পুস্তিকা কেজিএফের টাকায় প্রকাশ করেন বখতিয়ার প্রতিটিতে খরচ হয় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা। এর বাইরে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে কেজিএফ থেকে নেন ১০ কোটি টাকা। বখতিয়ার তাঁর আপন ভাগনি সারজানা রহমানকে চুক্তিভিত্তিক অ্যাসিস্ট্যান্টমেন্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে চাকরিও দেন।
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার নিজের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের অধীন সবকটি অধিদপ্তর বা সংস্থায়ই স্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে খবরদারি করতেন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিজের পছন্দের কর্মকর্তাদের বসাতেন। মূলতঃ চিহ্নিত দুর্নীতিবাজরাই ছিলো তার পছন্দের তালিকায়। চাকরির মেয়াদ না থাকলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ব্যবস্থা করে দিতেন। আর এসব প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্যিক টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ দুর্নীতিসহ নানা অনিয়ম অপকর্মের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। এসব টাকার অধিকাংশই বিদেশে পাচার করেছেন। দেশেও নামে-বেনামে সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে একটি, উত্তরায় একটি দিয়াবাড়িতে রাজউকের তৃতীয় ফেজ ব্লক ১৮তে একটি প্লট। এছাড়াও তাদের স্বামী-স্ত্রীর নামে আরও তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা যায়। গাজীপুরের টিএন্ডটি অফিস সংলগ্ন একটি ৫ কাঠা প্লট ক্রয় করেছেন। তথ্য গোপন করে প্রতারণার মাধ্যমে উত্তরা রাজউক এর ৫ কাঠার একটি প্লট বরা নিয়েছেন। উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পলায়নের পর স্বামী-স্ত্রী দু’জনই বেশ কয়েকদিন আত্মগোপনে ছিলেন। পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার পর অফিসেও আসতে শুরু করেছিলেন কিন্তু ছাত্র-জনতার দাবির মুখে চাকরি থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন।