1. admin@chandpurjomin.com : chadpuromin :
  2. editor@chandpurjomin.com : edtr :
শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৩২ অপরাহ্ন

মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে সড়কে, রোধ কীভাবে?

নিজ্বস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেটঃ শনিবার, ২২ জুন, ২০২৪
  • ১৬১ পড়েছেনঃ

দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। কিছুতেই এর লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। উদ্যোগ তো কম নেওয়া হয়নি। মোটরযান আইনের সংস্কার করা হলো। জাতীয় পরিবহন কমিটি সারা বছরই সভা, আলোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি কার্যক্রম করেই যাচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও বিশেষজ্ঞরা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দোষারোপ করছেন এবং নানাবিধ পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

বেসরকারি সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবমতে, ২০২৩ সালে দেশে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯০২ জনের মৃত্যু হয় এবং ১০ হাজার ৩৭২ জন আহত হন। ২০২৪ সালে ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে অর্থাৎ ঈদের ছুটি ও ঈদের উৎসব পালনের পক্ষকালে দেশে দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত হন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হারও বেশি। বড় বড় শহর ও মহানগরীতে এবং কখনো কখনো মহাসড়কে যানজট একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

ঢাকা মহানগরে আপনি ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরত্বের কোনো গন্তব্যে যদি যান এবং বাসস্থানে ফেরত আসেন, তাহলে ওই দিন আপনার আর কোনো কাজ করার সময় থাকবে না। যানজটে কর্মঘণ্টা যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি নাগরিকদের দুর্ভোগ ও কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সরকারের প্রচেষ্টার কমতি নেই। মেট্রোরেল হলো, এক্সপ্রেসওয়ে হলো, ফ্লাইওভার হলো। কিন্তু অবস্থার প্রত্যাশিত পরিবর্তন হলো না। মেট্রোরেলের সেবা ঢাকা শহরের সব অঞ্চলের নাগরিকরা পাচ্ছেন না। তেমনি এক্সপ্রেসওয়ের সেবা কেবল ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারী কিছুসংখ্যক নাগরিক পাচ্ছেন।

ফ্লাইওভারেও যানজট লেগে থাকে, হানিফ ফ্লাইওভারে তো এটা নিত্যদিনের ঘটনা।যানজটে মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। আবার রাস্তা ফাঁকা হলে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু বেড়ে যায়। ঈদের ছুটিতে যখন সড়কে যানবাহন কম থাকে, তখন দুর্ঘটনা ও মৃত্যুও বেড়ে যায়। শত শত পরিবারের ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে যায়। সড়ক ও মহাসড়কে যানজট, দুর্ঘটনা ও মৃত্যু হ্রাসের জন্য বুয়েটসহ অন্যান্য যেসব গবেষণা সংস্থা দুর্ঘটনাসংক্রান্ত গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত, পরিসংখ্যান ও সুপারিশ উপস্থাপন করছে, বাস্তব ক্ষেত্রে তার ইতিবাচক প্রভাব কতটুকু পড়ছে?

,এ ক্ষেত্রে যদি ইতিবাচক প্রভাব থাকত, তাহলে দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও যানজট হ্রাস পেত। তা তো হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? তবে কী করা যায়? এখন এ ব্যাপারে গবেষণা প্রয়োজন। প্রচলিত চলমান কার্যক্রমে কোথায় গলদ তা চিহ্নিত করতে না পারলে এসব গবেষণা, তথ্য-উপাত্ত, পরিসংখ্যান ও গালভরা বুলি কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না। সড়ক, মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর কারণ সব মহল কর্তৃক মোটামুটি চিহ্নিত হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের মতামতে সমস্যাগুলো স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু সমস্যা সমাধানের জন্য যে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে তা যথার্থভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমে সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করতে হয়। তারপর সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধানের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। /

,পরিকল্পনা বাস্তবায়নও সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে হতে হয়। এ ক্ষেত্রে সব স্টেকহোল্ডারের আন্তরিকতা ও স্বেচ্ছায় অবদান রাখা জরুরি। তদারক ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হয়। কেবল আনুষ্ঠানিকতা ও কথামালা দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আমরা সবাই কথা বলতে ভালোবাসি। :

কিন্তু নিজে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে চাই না। অনেক ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগও থাকে না। আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যের মানসিকতা পরিহার করে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের কাজ করার ক্ষেত্র নির্ধারণ করে দিতে হবে। তাদের যুক্তিসংগত মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে।-

‘সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয় তা নিম্নরূপ:-

১. চালক ও হেলপারদের অদক্ষতা, দায়িত্বহীনতা, আইনকানুন মেনে না চলা, বেপরোয়াভাবে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো, ঝুঁকি নিয়ে ওভারটেক করা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়ে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালানো, পেশাদারত্বের অভাব, নিজের এবং যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য চালকদের নিরাপত্তা জ্ঞান ও বোধের অভাব ইত্যাদি।

. সড়কে আনফিট গাড়ি চলাচল, গাড়ির আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হওয়ার পরও গাড়ি সড়কে চালানো এবং প্রতিদিন গাড়ির প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ যেমন- ব্রেক,  রেডিওটর,  ব্যাটারির পানি ইত্যাদি নিয়মিত পরীক্ষা না করা, আনফিট গাড়িকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া ইত্যাদি।;

.  রাস্তা নির্মাণে কোথাও কোথাও ত্রুটি থাকায় ওই সব স্থান দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় পরিণত হয়। রোড ম্যানেজমেন্ট ও ট্রাফিক সাইন-সিগন্যাল প্রয়োজনীয় স্থানে না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটে। ;

৪. বিআরটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পুলিশের কর্তব্যকর্মে অবহেলা, অস্বচ্ছ আচরণ ও অসদাচরণ চালকদের বেপরোয়া করে তোলে। /

. পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সমিতির সদস্যদের উদাসীনতা, চালক নিয়োগে যোগ্যতা যাচাই না করা। প্রতি গাড়ির জন্য দুজন চালক নিয়োগ না করা, চালক ও হেলপারদের কল্যাণ না দেখা, তাদের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম না দেওয়া, চালক ও হেলপারদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক প্রোগ্রামের ব্যবস্থা না করা, গাড়ির ফিটনেস আপডেট না রাখা ইত্যাদি কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। মালিক ও শ্রমিক সংগঠন এ দায় থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। পরিবহন ব্যবসা একটি সেবাধর্মী পেশা। মালিক ও শ্রমিকরা এ প্রতিপাদ্য অনুধাবন করতে পারে না এবং কর্মক্ষেত্রে চর্চাও করে না। তারা শুধু টাকা রোজগারের ওপর জোর দেয়। যাত্রীসেবা, যাত্রীকল্যাণ ও তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি মালিক ও শ্রমিক উভয়ের কাছেই গৌণ। ;

. মহাসড়ক অননুমোদিত যানবাহন যেমন- মোটরবাইক, ইজিবাইক, নছিমন, সিএনজি, রিকশা  ইত্যাদি ধীর গতির যানবাহন চলাচল করায় এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই এমন ব্যক্তিরা গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে।  ”

উপরিউক্ত কারণগুলোর মধ্যে ১ নম্বর কারণে প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। সড়কে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন সচল রাখার জন্য যে জনশক্তি (চালক ও হেলপার) সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, সেই জনশক্তিকে নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। চালকরা হেলপারের দায়িত্ব পালনকালে নিজ উদ্যোগে এবং চালকদের সহায়তায় গাড়ি চালানো শেখে। তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেই। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করতে হলে প্রথমে চালকদের দিকে নজর দিতে হবে। :

‘ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করার আগে প্রত্যেক চালককে কমপক্ষে ১৫ দিন ট্রাফিক আইন-বিধি এবং ট্রাফিক সিগন্যালের ওপর কার্যকরভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। প্রশিক্ষণ চলাকালে চালকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে লেকচার, আলোচনা ও সেমিনারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গাড়ি চালানো যে একটি দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা এবং চালকের অসতর্কতার জন্য যাত্রী ও চালক উভয়ের জীবন বিপন্ন হতে পারে, এ ব্যাপারে তাদের সংবেদনশীল করা আবশ্যক। এ কাজটি বিআরটিএকেই করতে হবে। :

:একই সঙ্গে সব পরিবহনশ্রমিককে এক হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং দাবি জানাতে হবে যে, তারা আনফিট গাড়ি চালাবেন না এবং প্রতি গাড়িতে দুজন চালক রাখতে হবে, যাতে তারা প্রয়োজনীয় বিশ্রামের পর শিফটে ডিউটি করতে পারেন। চালকদের চাপে মালিকরাও তাদের গাড়ি সঠিকভাবে ফিট রাখতে এবং প্রতি গাড়িতে দুজন চালক রাখতে বাধ্য হবেন।  ;

;চালকরা যদি আইনকানুন মেনে নিজের ও যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে দায়িত্ববান হয়ে গাড়ি চালান, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টকে যদি আধুনিক ও ডিজিটালাইজড করা হয় এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ করে সড়কে শৃঙ্খলা আনা যায়, তবে আমার বিশ্বাস, সড়ক দুর্ঘটনা বহুলাংশে কমে যাবে।:

:চালক ও হেলপারদের দক্ষ, সচেতন ও পেশাদার জনশক্তিতে রূপান্তর করা গেলে অন্য সমস্যাগুলোও  পর্যায়ক্রমে সমাধান হবে। প্রথম পর্যায়ে চালকদের ইস্যু নিয়ে কাজগুলো করতে হবে। পরে প্রতিটি কারণ বিশ্লেষণ করে তা নিরসনের পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ব্যাপারে বিআরটিএ, পুলিশ এবং পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সমিতিকেই সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।।

লেখক: একে এম শহীদুল হক

সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ

শেয়ার করুন

আরও পড়ুন
All Rights Reserved ©2024
Theme Customized By LiveTV